ওয়াসওয়াসা রোগের জন্য রুকইয়া

ভূমিকা

ওয়াসওয়াসা (وسوسة) হলো শয়তানের একটি ফাঁদ। মানুষকে মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে দুর্বল করে ফেলার জন্য শয়তান তার মনে সন্দেহ, ভয় ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। নামাজে মনোযোগ হারানো, ওজু নিয়ে বারবার সন্দেহ হওয়া বা ঈমান নিয়ে ভয়—এসবই ওয়াসওয়াসার লক্ষণ।

ওয়াসওয়াসা রোগের জন্য রুকইয়া

আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন —

“যে শয়তান মানুষের মনে কুমন্ত্রণা দেয়।”
সূরা আন-নাস: ৪–৫

ওয়াসওয়াসা এমন এক রোগ, যা মানুষকে ধীরে ধীরে ঈমান থেকে দূরে নিয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর সাহায্য ও রুকইয়ার মাধ্যমে এর চিকিৎসা সম্ভব।

ওয়াসওয়াসা রোগের লক্ষণ

ওয়াসওয়াসা শুধু মানসিক সমস্যা নয়, এটি আত্মিক দুর্বলতারও লক্ষণ। সাধারণত নিম্নলিখিত উপসর্গগুলো দেখা যায়👇

  • নামাজে মনোযোগ হারানো বা বারবার সালাত পুনরায় পড়া
  • ওজু ঠিক হয়েছে কি না—এই সন্দেহে বারবার ওজু করা
  • কুরআন, আল্লাহ বা নবী সম্পর্কে অশুভ চিন্তা আসা
  • মনে ভয়, হতাশা বা শূন্যতার অনুভূতি
  • নিজের ঈমান নিয়ে অযথা সন্দেহ

এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে তা অবহেলা না করে রুকইয়া শুরু করা উচিত।

ওয়াসওয়াসার মূল কারণ

ওয়াসওয়াসার মূল উৎস হলো শয়তান। তবে কিছু মানসিক কারণও একে বাড়িয়ে তোলে।

1 শয়তানের কুমন্ত্রণা:
শয়তান মানুষের মনে সন্দেহ ও ভ্রান্তি ঢুকিয়ে তাকে বিভ্রান্ত করে।

“নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের শত্রু, সুতরাং তোমরাও তাকে শত্রু মনে করো।”
সূরা ফাতির: ৬
2 দুর্বল ঈমান ও গুনাহ:
যখন মানুষ নামাজ, কুরআন ও জিকির থেকে দূরে থাকে, তখন তার আত্মা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শয়তান সহজেই প্রভাব ফেলে।

3 অতিরিক্ত ভয় বা মানসিক চাপ:

চিন্তাভাবনা, দুশ্চিন্তা বা অতিরিক্ত পারফেকশনিজম থেকেও ওয়াসওয়াসা তৈরি হয়।

ওয়াসওয়াসা থেকে মুক্তির ইসলামী উপায়

ওয়াসওয়াসা থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু চিকিৎসা নয় — বিশ্বাস, আমল ও ধৈর্য প্রয়োজন।

  • নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা
  • কুরআন তিলাওয়াত ও অর্থ বোঝা
  • “আউযু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম” বলা যখন সন্দেহ আসে
  • ইতিবাচক চিন্তা করা ও আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখা
  • শয়তানের ফুঁসফুঁসানি উপেক্ষা করা

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:

“যখন শয়তান তোমাদের মনে কিছু ফিসফিসায়, তখন বলো ‘আউযু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম’। এতে শয়তান পালিয়ে যায়।”

— (সহিহ বুখারি)

রুকইয়া কী এবং কেন এটি কার্যকর

রুকইয়া (রুকইয়াহ শারইয়াহ) মানে হলো কুরআনের আয়াত ও সহিহ দোয়ার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক চিকিৎসা করা।
রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজেও রুকইয়া করতেন এবং অন্যদের করতেও উৎসাহ দিয়েছেন।

“যে ব্যক্তি কুরআনের আয়াত ও দোয়ার মাধ্যমে চিকিৎসা করে, তাতে কোনো সমস্যা নেই।”
(সহিহ মুসলিম)

রুকইয়া শুধু জিন বা বদনজরের জন্য নয় — বরং ওয়াসওয়াসা, ভয় ও মানসিক অস্থিরতার ক্ষেত্রেও কার্যকর চিকিৎসা।

ওয়াসওয়াসা রোগের জন্য রুকইয়ার পদ্ধতি

নিচে সহিহ কুরআনের আয়াত ও দোয়ার মাধ্যমে রুকইয়ার সহজ পদ্ধতি দেওয়া হলো

রুকইয়ার জন্য কুরআনের আয়াত

১. সূরা আল-ফাতিহা
২. সূরা আল-বাকারা:

  • আয়াতুল কুরসী (২:২৫৫)
  • শেষ দুই আয়াত (২৮৫–২৮৬)
    ৩. সূরা আল-ইখলাস
    ৪. সূরা আল-ফালাক
    ৫. সূরা আন-নাস প্রতিটি সূরা ৩ বার করে পড়তে হবে সকাল ও রাতে।

রুকইয়ার ধাপ

  1. পবিত্র অবস্থায় ওজু করে বসো।
  2. আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিয়ত করো — “ওয়াসওয়াসা থেকে মুক্তির জন্য রুকইয়া করছি।”
  3. উপরোক্ত আয়াত ও সূরাগুলো পড়ো এবং নিজের মাথা, বুক ও শরীরে ফুঁ দাও।
  4. পানিতে পড়ে ফুঁ দিয়ে সেই পানি পান করাও বা গোসলের সময় ব্যবহার করো।
  5. এই আমল প্রতিদিন চালিয়ে যাও যতদিন না শান্তি আসে।

অতিরিক্ত দোয়া

আউযু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম
بِسْمِ اللهِ الَّذِي لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ
(উচ্চারণ: বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়াদুররু মা’আসমিহি শাইউন ফিল আরদি ওয়ালা ফিস সামা’ই, ওয়া হুয়াস সামিউল আলিম)

অর্থ: “আল্লাহর নামে (যার নামে) কোনো কিছুই ক্ষতি করতে পারে না, আসমান বা জমিনে; তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।”

ওয়াসওয়াসা রোগীর জন্য করণীয় টিপস

  • ভয় বা সন্দেহ এলে “আউযু বিল্লাহ” পড়ে আমল চালিয়ে যাও
  • একা না থেকে আমলদার বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটাও
  • হারাম কাজ ও সন্দেহজনক বিষয় থেকে দূরে থাকো
  • নিয়মিত সূরা আল-বাকারা ঘরে পাঠ করো
  • ঘুমানোর আগে আয়াতুল কুরসী ও তিন কুল পাঠ করো

উপসংহার

ওয়াসওয়াসা হলো শয়তানের ফাঁদ, যা মানুষের ঈমান নষ্ট করে দেয়। কিন্তু আল্লাহর সাহায্যে এর চিকিৎসা সম্ভব।
রুকইয়া শারইয়াহ হলো সেই আধ্যাত্মিক চিকিৎসা, যা মুমিনের অন্তরে শান্তি এনে দেয় এবং ওয়াসওয়াসা দূর করে।

“আর আমি কুরআনে যা নাযিল করেছি, তা মুমিনদের জন্য শিফা ও রহমত।”
সূরা আল-ইসরা: ৮২

সুতরাং, আল্লাহর দিকে ফিরে আসো, নিয়মিত আমল করো, এবং ওয়াসওয়াসা থেকে মুক্তির জন্য রুকইয়া করো —
ইনশাআল্লাহ অন্তর শান্তি ও প্রশান্তিতে ভরে উঠবে।


FAQ (প্রশ্নোত্তর)

প্রশ্ন ১: ওয়াসওয়াসা কি মানসিক না আধ্যাত্মিক রোগ?
উত্তর: এটি আধ্যাত্মিক রোগ, যা শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে সৃষ্টি হয়। তবে মানসিক দুর্বলতা একে বাড়িয়ে তোলে।

প্রশ্ন ২: রুকইয়া কি নিজে করা যায়?
উত্তর: হ্যাঁ, সহিহ দোয়া ও কুরআনের আয়াত পড়েই নিজে রুকইয়া করা যায়। এটি সুন্নত পদ্ধতি।

প্রশ্ন ৩: রুকইয়া করতে কি কোনো বিশেষ মানুষ দরকার?
উত্তর: না, প্রত্যেক মুসলমান নিজে রুকইয়া করতে পারে। তবে আমলদার ব্যক্তির সাহায্য নেওয়াও বৈধ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top