বাচ্চাদের কান্না থামানোর দোয়া: ইসলামিক দৃষ্টিতে সান্ত্বনা ও সুরক্ষার পথ

ভূমিকা: কেন বাচ্চারা হঠাৎ কান্না করে?

বাচ্চাদের কান্না থামানোর দোয়া

প্রত্যেক শিশু আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ নিয়ামত। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়—
বাচ্চা হঠাৎ কান্না শুরু করে, কোনো কারণ ছাড়াই কাঁদে, রাতে ঘুমায় না, ভয় পায় বা কিছু দেখে আঁতকে ওঠে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এগুলোর কারণ হতে পারে ক্ষুধা, গ্যাস, ঘুমের সমস্যা বা কোনো শারীরিক অস্বস্তি।
তবে ইসলাম আমাদের শেখায়— অনেক সময় অদৃশ্য জগৎ (যেমন: জিন বা নজর) থেকেও শিশু প্রভাবিত হতে পারে।

সেই অবস্থায় কেবল ডাক্তার নয়, বরং আল্লাহর সাহায্যই হলো প্রকৃত সমাধান।
এক্ষেত্রে কুরআন ও দোয়া আমাদের সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা ও সুরক্ষার মাধ্যম। বাচ্চাদের কান্না থামানোর দোয়া

বাচ্চাদের কান্না থামানোর দোয়া

বাচ্চাদের জন্য দোয়া ও রুকইয়াহ: নবী ﷺ-র শিক্ষা

নবী মুহাম্মদ ﷺ নিজে শিশুদের জন্য দোয়া পড়তেন, এমনকি তাঁর নাতি হাসান ও হুসাইন (রাঃ)-এর জন্যও তিনি বিশেষ দোয়া পড়তেন।

হাদীসে এসেছে —

ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, নবী ﷺ বলতেন:

“أُعِيذُكُمَا بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ، وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لَامَّةٍ”

উচ্চারণ: উ’ঈযুকুমা বিকালিমাতিল্লাহিত-তাম্মাতি মিন কুল্লি শাইতানিন ওয়া হাম্মাতিন, ওয়া মিন কুল্লি আইনিন লাম্মাহ।

অর্থ: “আমি আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ কালিমার মাধ্যমে তোমাদেরকে আশ্রয় দিচ্ছি, সব শয়তান, বিষাক্ত প্রাণী এবং কুদৃষ্টির অনিষ্ট থেকে।”
(সহীহ বুখারী, হাদীস: ৩৩৭১)

এটি নবী ﷺ নিজে তাঁর দোয়া হিসেবে ব্যবহার করতেন। আজও মুসলিম মায়েরা-বাবারা বাচ্চাদের জন্য এই দোয়া পড়তে পারেন।

দোয়া ও আয়াত যা বাচ্চার কান্না শান্ত করে: বাচ্চাদের কান্না থামানোর দোয়া

নিচে কিছু কুরআন ও হাদীস ভিত্তিক দোয়া ও আয়াত দেওয়া হলো, যা বাচ্চার কান্না থামানো, ভয় দূর করা ও ঘুমের প্রশান্তির জন্য উপকারী।

১. সূরা আল-ফালাক (সূরা ১১৩)

“قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ …”

অর্থ: “বল, আমি আশ্রয় চাই প্রভাতের পালনকর্তার নিকট, তাঁর সৃষ্টির অনিষ্ট থেকে।”

কেন পড়া উচিত:
এই সূরাটি শয়তান, জাদু, এবং কুদৃষ্টির প্রভাব থেকে সুরক্ষা দেয়।
রাতের বেলা বাচ্চার উপর ফুঁ দিয়ে পড়লে তার ভয় ও কান্না কমে যায়।

২. সূরা আন-নাস (সূরা ১১৪)

“قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ …”

অর্থ: “বল, আমি আশ্রয় চাই মানুষের প্রতিপালকের নিকট, কুমন্ত্রণা প্রদানকারী শয়তানের অনিষ্ট থেকে।”

উপকারিতা:
এটি মন শান্ত করে, ভয় ও শয়তানের প্রভাব দূর করে।
নবী ﷺ ঘুমানোর আগে এই সূরা নিয়মিত পড়তেন।

৩. সূরা আল-ইখলাস (সূরা ১১২)

“قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ …”

অর্থ: “বল, তিনি আল্লাহ, একমাত্র।”

উপকারিতা:
এই সূরাটি তাওহিদের ঘোষণা এবং রুহানিয় শক্তি প্রদান করে।
এটি পড়লে মন ও শরীরে প্রশান্তি আসে।

৪. বাচ্চার সুরক্ষার জন্য সাধারণ দোয়া:বাচ্চাদের কান্না থামানোর দোয়া

“بِسْمِ اللهِ الَّذِي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاءِ، وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ”

উচ্চারণ: বিসমিল্লাহিল্লাযি লা ইয়াদুর্রু মা’আসমিহি শাইউন ফিল আরদি ওয়ালা ফিস-সামা, ওয়া হুয়াস-সামিউল আলিম।

অর্থ: “আল্লাহর নামে, যার নামের সাথে আসমান ও জমিনে কোনো কিছুই ক্ষতি করতে পারে না; তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।”
(সহীহ তিরমিযি, ৩৩৮৮)

এটি দিনে তিনবার পড়া যেতে পারে — বিশেষ করে সকাল, সন্ধ্যা ও ঘুমানোর আগে।

৫. সূরা আল-বাকারা থেকে আয়াতুল কুরসি (২:২৫৫)

“اللّهُ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ …”

এই আয়াত শয়তান ও অদৃশ্য প্রভাব থেকে সুরক্ষা দেয়।
বাচ্চার ঘরে এই আয়াত বাজানো বা পাঠ করা খুবই বরকতময়।

রুকইয়াহ শারইয়াহ পদ্ধতিতে বাচ্চার উপর দোয়া পড়ার উপায়

নবী ﷺ-এর নির্দেশনা অনুযায়ী নিচের সহজ ও শরীয়তসম্মত পদ্ধতিতে রুকইয়াহ করা যেতে পারে —

  1. অজু করে বা পবিত্র অবস্থায় বসা।
  2. উল্লিখিত সূরা ও দোয়াগুলো পড়া।
  3. হাতে ফুঁ দিয়ে বাচ্চার মাথা, বুক ও পুরো শরীরে আলতো করে মুছে দেওয়া।
  4. যদি বাচ্চা ঘুমায়, তবে ঘুমন্ত অবস্থায়ও আল্লাহর নামে ফুঁ দেওয়া যায়।
  5. প্রতিদিন ফজর ও মাগরিবের পর এই রুকইয়াহ পড়লে সর্বোত্তম ফল পাওয়া যায়।

সতর্কতা: রুকইয়াহর নামে ভ্রান্ত কাজ থেকে বিরত থাকুন

বর্তমানে অনেক জায়গায় বাচ্চার কান্না থামানোর নামে তাবিজ, ঝাড়ফুঁক, বা অজানা মন্ত্র ব্যবহার করা হয়।
এসব কাজ শরীয়াহ-বিরোধী এবং শিরক (অংশীদার করা) হিসেবে গণ্য হতে পারে।

তাই মনে রাখবেন —
দোয়া ও রুকইয়াহ শুধু আল্লাহর কালাম দিয়েই হতে হবে।
কোনো জাদু, সংখ্যা, বা পীরের নাম নয়।

বাচ্চার কান্না থামানোর দোয়া পাঠের সময় কিছু সুন্নাহ অনুসরণ

  • বাচ্চাকে আদর ও ভালোবাসা দিয়ে শান্ত করুন।
  • ঘুমের আগে আযান ও ইকামত দিন (নবজাতকের জন্য)।
  • আয়াতুল কুরসি, সূরা আল-ইখলাস, সূরা আল-ফালাক, সূরা আন-নাস নিয়মিত পড়ুন।
  • ঘরের পরিবেশ শান্ত রাখুন এবং কুরআনের তেলাওয়াত চালু রাখুন।

দোয়ার পাশাপাশি অভিভাবকের দায়িত্ব

বাচ্চা কাঁদলে প্রথমেই দেখতে হবে—
সে ক্ষুধার্ত কি না,
তার ডায়াপার ভেজা কি না,
কোনো অসুস্থতা বা গ্যাসের সমস্যা আছে কি না।

চিকিৎসার পাশাপাশি দোয়া করলে আল্লাহর রহমতে দ্বিগুণ উপকার পাওয়া যায়।

ইসলাম কখনো চিকিৎসা বা চিকিৎসককে অস্বীকার করেনি, বরং বলেছেন —

“আল্লাহ যে রোগ দিয়েছেন, তার চিকিৎসাও দিয়েছেন।” (সহীহ বুখারী)

উপসংহার

বাচ্চাদের কান্না কখনোই অবহেলা করা উচিত নয়।
যদি কোনো শারীরিক কারণ না থাকে, তবে মনে রাখতে হবে — হয়তো আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা করছেন, অথবা অদৃশ্য কোনো প্রভাব কাজ করছে।

এই অবস্থায় রুকইয়াহ শারইয়াহনবী ﷺ প্রদত্ত দোয়া সবচেয়ে নিরাপদ ও বরকতময় উপায়।

“আল্লাহর কালামেই আছে শিফা।” (সূরা আল-ইসরা ১৭:৮২)

অতএব, বাচ্চার জন্য প্রতিদিন দোয়া করুন, কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করুন এবং আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখুন।
আল্লাহই শিশুদের প্রকৃত রক্ষাকারী ও শান্তিদাতা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top