রুকইয়াহ শারইয়াহ: সুরক্ষা এবং সুস্থতার ইসলামী পদ্ধতি

ভূমিকা: আত্মিক ও শারীরিক সুস্থতার ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

রুকইয়াহ শারইয়াহ: সুরক্ষা এবং সুস্থতার ইসলামী পদ্ধতি

রুকইয়াহ শারইয়াহ: সুরক্ষা এবং সুস্থতার ইসলামী পদ্ধতি
রুকইয়াহ শারইয়াহ: সুরক্ষা এবং সুস্থতার ইসলামী পদ্ধতি

বর্তমান যুগে মানুষ যত বেশি প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত হচ্ছে, ততই মানসিক চাপ, ভয়, উদ্বেগ এবং অজানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক কিছু ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু আত্মার অশান্তি বা অদৃশ্য প্রভাবের সমাধান দিতে পারে না।

ইসলাম এই সমস্যার জন্য একটি পবিত্র ও নিরাপদ সমাধান দিয়েছে — রুকইয়াহ শারইয়াহ (Ruqyah Shariah)
এটি এমন একটি আত্মিক চিকিৎসা পদ্ধতি যা কুরআন ও সহীহ হাদীসের দোয়ার মাধ্যমে মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে আরোগ্য লাভে সাহায্য করে।

রুকইয়াহ শারইয়াহ কী?

“রুকইয়াহ” (الرقية) শব্দের অর্থ হলো ঝাড়ফুঁক বা আয়াত ও দোয়া দ্বারা চিকিৎসা।
আর “রুকইয়াহ শারইয়াহ” মানে —

আল্লাহর কালাম (কুরআন) ও নবী ﷺ-প্রদত্ত দোয়া পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর অনুমতিক্রমে শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক রোগ থেকে আরোগ্য লাভের বৈধ পদ্ধতি।

🔹 এটি জাদু, তাবিজ বা শিরক নয়।
🔹 এটি আল্লাহর নির্দেশিত ও নববী সুন্নাহ-সম্মত চিকিৎসা।

রুকইয়াহ শারইয়াহর কুরআন ও হাদীস ভিত্তি

কুরআনের প্রমাণ

“আর আমি কুরআনে এমন কিছু অবতীর্ণ করেছি যা মুমিনদের জন্য শিফা (আরোগ্য) ও রহমত।”
(সূরা আল-ইসরা ১৭:৮২)

“বলুন, এটি মুমিনদের জন্য দিকনির্দেশনা ও শিফা।”
(সূরা ফুসসিলাত ৪১:৪৪)

এই আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে কুরআন কেবল দিকনির্দেশনা নয়, বরং আত্মিক চিকিৎসারও উৎস।

হাদীসের প্রমাণ

নবী করিম ﷺ বলেছেন:

“যে রুকইয়াহ করে এবং তাতে শিরক নেই, সে রুকইয়াহ বৈধ।”
(সহীহ মুসলিম)

এক সাহাবী সাপের কামড়ে আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর সূরা আল-ফাতিহা পড়ে ঝাড়ফুঁক করেন, এবং তিনি সুস্থ হয়ে যান।
নবী ﷺ এটি শুনে বলেন:

“তুমি ঠিক করেছো, আল-ফাতিহা তো শিফা।”
(সহীহ বুখারী)

রুকইয়াহর দুই প্রকার

১. আত্মিক রুকইয়াহ (Self-Ruqyah)

নিজে নিজের জন্য কুরআনের আয়াত ও দোয়া পড়ে আল্লাহর সাহায্য চাওয়াকে বলা হয় আত্মিক রুকইয়াহ।
এটি সর্বাধিক নিরাপদ ও সুন্নাহ-সম্মত পদ্ধতি।

২. অন্যের জন্য রুকইয়াহ (Ruqyah for Others)

যখন কোনো আলেম বা নেক ব্যক্তি অন্যের জন্য কুরআন পড়ে ঝাড়ফুঁক করেন।
তবে তিনি যেন কেবল কুরআন ও সহীহ দোয়া ব্যবহার করেন, কোনো তাবিজ বা অজানা শব্দ নয়।

রুকইয়াহ করার ইসলামী শর্ত ও মূলনীতি

রুকইয়াহ শারইয়াহ হলো কুরআন ও হাদীসের দোয়া দ্বারা শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক রোগ নিরাময়ের একটি ইসলামী পদ্ধতি। এটি করতে হলে কিছু শর্ত মানা জরুরি—দোয়াগুলো হতে হবে কুরআন ও সহিহ হাদীস থেকে, শিরকমুক্ত থাকতে হবে, এবং বিশ্বাস রাখতে হবে যে শিফা দানকারী একমাত্র আল্লাহ তাআলা। রুকইয়াহ করার সময় শুদ্ধ আকিদা ও আন্তরিক নিয়ত থাকা উচিত। তাবিজ, মন্ত্র বা কুসংস্কার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আমি কুরআনে এমন জিনিস নাজিল করেছি যা মুমিনদের জন্য শিফা ও রহমত” (সূরা আল-ইসরা ১৭:৮২)। সঠিক নিয়মে রুকইয়াহ করলে আল্লাহর ইচ্ছায় এতে বরকত ও আরোগ্য আসে।

১. আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কারও উপর নির্ভর নয়।
২. শুধু কুরআন ও সহীহ দোয়া ব্যবহার করতে হবে।
৩. তাবিজ, মন্ত্র, সংখ্যা বা জাদু ব্যবহার নিষিদ্ধ।
৪. পূর্ণ ঈমান ও তাওয়াক্কুল থাকতে হবে।
৫. রুকইয়াহ শিরকমুক্ত ও শরীয়তসম্মত হতে হবে।

রুকইয়াহ শারইয়াহ করার পদ্ধতি (Step-by-Step Guide)

ধাপ ১: নিয়ত ও প্রস্তুতি

  • শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আরোগ্য লাভের নিয়ত করতে হবে।
  • অজু বা গোসল করে পবিত্র অবস্থায় বসা উত্তম। ধাপ ২: পাঠযোগ্য আয়াত ও দোয়া

নিচের সূরাগুলো ও দোয়াগুলো রুকইয়াহর জন্য সবচেয়ে উপকারী:

🔹 কুরআনের আয়াতসমূহ

  • সূরা আল-ফাতিহা
  • আয়াতুল কুরসি (সূরা আল-বাকারা ২:২৫৫)
  • সূরা আল-বাকারা (শেষ দুই আয়াত: ২:২৮৫–২৮৬)
  • সূরা আল-ইখলাস
  • সূরা আল-ফালাক
  • সূরা আন-নাস সহীহ দোয়াসমূহ

“আউযু বিকালিমাতিল্লাহিত-তাম্মাতি মিন শাররি মা খালাক।”
(আমি আশ্রয় চাই আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ কালিমার মধ্যে, তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট থেকে।)

“বিসমিল্লাহিল্লাযি লা ইয়াদুর্রু মাআস্মিহি শাইউন ফিল আরদি ওয়ালা ফিসসামা, ওয়া হুয়াস সামিউল আলিম।”
(আল্লাহর নামে, যার নামের সাথে কোনো কিছু ক্ষতি করতে পারে না, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।)

ধাপ ৩: ফুঁ দেওয়া ও মুছে নেওয়া

দোয়া পড়ার পর হাতে ফুঁ দিয়ে পুরো শরীরে মুছে নিতে হয়, অথবা পানিতে ফুঁ দিয়ে সেই পানি পান করা যায়।

ধাপ ৪: নিয়মিত আমল

প্রতিদিন ফজর ও মাগরিবের পর এই রুকইয়াহ আমল করলে আত্মিক সুরক্ষা বজায় থাকে।

রুকইয়াহ শারইয়াহর মাধ্যমে সুরক্ষা লাভ

রুকইয়াহ কেবল রোগ নিরাময়ের জন্য নয়; এটি একটি আত্মিক সুরক্ষা ব্যবস্থা
এর মাধ্যমে মানুষ রক্ষা পায় —

  • জিন ও শয়তানের প্রভাব থেকে
  • কালো জাদু ও নজর লাগা থেকে
  • ভয়, উদ্বেগ ও দুঃস্বপ্ন থেকে
  • আত্মিক দুর্বলতা ও মানসিক অশান্তি থেকে

নবী ﷺ প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে সূরা আল-ইখলাস, আল-ফালাক ও আন-নাস পড়ে নিজের উপর ফুঁ দিতেন।
এটি তাঁর দৈনন্দিন রুকইয়াহ ও সুরক্ষা আমল ছিল।

ভ্রান্ত রুকইয়াহ ও প্রতারণা থেকে সাবধান

আজকাল অনেকেই “রুকইয়াহ” নাম ব্যবহার করে মানুষকে প্রতারিত করছে।
তাই নিচের কাজগুলো থেকে সতর্ক থাকুন —

তাবিজ, সংখ্যাতত্ত্ব বা অজানা মন্ত্র ব্যবহার
অর্থের বিনিময়ে “অলৌকিক চিকিৎসা” দাবি করা
নারী-পুরুষ একা একা থাকা বা শরীর স্পর্শ করা
কুরআনের আয়াত উল্টো করে বা বিকৃতভাবে পড়া

এগুলো শরীয়াহবিরোধী ও শিরকপূর্ণ কাজ, যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

রুকইয়াহ ও আধুনিক চিকিৎসা

রুকইয়াহ আধুনিক চিকিৎসার বিকল্প নয়, বরং একটি পরিপূরক আত্মিক চিকিৎসা পদ্ধতি।

  • শারীরিক অসুস্থতায় ডাক্তার দেখানো ও ওষুধ খাওয়া জরুরি।
  • আত্মিক অশান্তিতে রুকইয়াহ পড়া ও আল্লাহর উপর ভরসা করাও সমান জরুরি।

দুইটি একত্রে করলে আল্লাহর রহমতে দেহ ও আত্মা উভয়ই সুস্থতা পায়।

রুকইয়াহর উপকারিতা (Benefits of Ruqyah Shariah)

✅ আত্মিক প্রশান্তি ও মানসিক স্বস্তি বৃদ্ধি করে
✅ ভয়, দুঃস্বপ্ন ও নেতিবাচক চিন্তা দূর করে
✅ জাদু ও নজর লাগা থেকে সুরক্ষা দেয়
✅ ঈমান ও তাওয়াক্কুল বৃদ্ধি করে
✅ মন, দেহ ও আত্মার মধ্যে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে

উপসংহার: আল্লাহর কালামই প্রকৃত শিফা

রুকইয়াহ শারইয়াহ ইসলামি জীবনধারার একটি অপরিহার্য অংশ, যা আমাদের শেখায়—
আরোগ্য কেবল আল্লাহর কাছ থেকেই আসে।

নবী ﷺ বলেছেন,

“আল্লাহ যে রোগ দিয়েছেন, তার চিকিৎসাও দিয়েছেন।” (সহীহ বুখারী)

তাই রুকইয়াহ শারইয়াহ হলো সেই আত্মিক চিকিৎসা যা মন, শরীর ও আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং ঈমানকে শক্তিশালী করে।
যারা আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখে, নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করে ও দোয়া পড়ে — তাদের জন্য রুকইয়াহ এক অমূল্য আশীর্বাদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top