মানবজীবনে অদৃশ্য জগতের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। আল্লাহ তাআলা কুরআনে স্পষ্টভাবে বলেছেন,
“তারা (যাদুকররা) এমন কিছু শিখে যা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটায়।” (সূরা আল-বাকারা ২:১০২) —
এখান থেকেই বোঝা যায়, সিহর বা জাদু বাস্তব এবং মানুষের জীবনে তা গভীর ক্ষতি করতে সক্ষম।
তবে আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোনো ক্ষতি হয় না। আর তাই আল্লাহ তাআলা আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে সিহরের প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে হয়। সেই মুক্তির অন্যতম উপায় হলো রুকইয়াহ শারইয়াহ — অর্থাৎ কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুযায়ী দোয়া ও আমল।

সিহর বা জাদু কীভাবে কাজ করে
সিহর বা জাদু সাধারণত জিন ও শয়তানের সাহায্যে করা হয়। কোনো ব্যক্তি, হিংসা বা শত্রুতার কারণে, জাদুকরের মাধ্যমে জিনকে পাঠায় লক্ষ্যবস্তুর উপর। ফলে তার শরীরে, মনে বা জীবনে নানা অস্বাভাবিক সমস্যা দেখা দেয়।
সিহরের কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:
- হঠাৎ অতিরিক্ত ভয় বা আতঙ্ক ।
- ঘুমে দুঃস্বপ্ন দেখা বা জিনের উপস্থিতি অনুভব ।
- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হঠাৎ সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাওয়া।
- মাথাব্যথা, বমি ভাব, শরীরে ভার অনুভব।
- নামাজে মনোযোগ হারানো বা কুরআন শুনলে অস্বস্তি।
এই লক্ষণগুলো থাকলেই অবশ্য নিশ্চিতভাবে জাদু বলা যায় না। তবে এসব লক্ষণ থাকলে রুকইয়াহ করা উত্তম।
রুকইয়াহ কী এবং কেন এটি করা হয়
রুকইয়াহ শব্দের অর্থ হলো আশ্রয় নেওয়া বা ঝাড়ফুঁক করা, তবে শরীয়তসম্মত রুকইয়াহ বলতে বোঝানো হয় এমন ঝাড়ফুঁক যা কুরআন ও সহীহ হাদীসের দোয়া ও আয়াত দ্বারা করা হয়, যেখানে কোনো শিরক বা কুফরি কথা থাকে না।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“যে ব্যক্তি কুরআন ও আল্লাহর নামে রুকইয়াহ করে, এতে কোনো সমস্যা নেই।” (সহীহ মুসলিম)
অর্থাৎ, রুকইয়াহ হলো এক প্রকার দোয়া, যা আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনার মাধ্যম।
সিহর বা জাদু নষ্টের কার্যকর রুকইয়াহ পদ্ধতি
১. নিজের উপর রুকইয়াহ করা
সবচেয়ে উত্তম রুকইয়াহ হলো নিজের দ্বারা নিজের জন্য করা রুকইয়াহ। এতে তাওয়াক্কুল (আল্লাহর উপর নির্ভরতা) দৃঢ় হয়।
পদ্ধতি:
- পরিষ্কার ও অজু অবস্থায় বসুন।
- নিচের আয়াতগুলো ধীরে ধীরে পড়ুন:
- সূরা আল-ফাতিহা (১ বার)
- আয়াতুল কুরসি (সূরা বাকারা ২:২৫৫)
- সূরা আল-বাকারা আয়াত ১০২
- সূরা আল-ইখলাস, আল-ফালাক ও আন-নাস (৩ বার করে)
- সূরা আ’রাাফ ১১৭-১২২
- সূরা ইউনুস ৮১-৮২
- সূরা ত্বাহা ৬৯
পড়ার সময় নিজের হাতে ফুঁ দিন এবং পুরো শরীরে হাত বুলিয়ে নিন। প্রতিদিন সকালে ও রাতে এটি করুন।
২. রুকইয়াহ পানি ও তেল ব্যবহার
রুকইয়াহ পানি তৈরি করা হয় কুরআনের আয়াত পড়ে পানিতে ফুঁ দিয়ে। এটি দিয়ে গোসল, পান ও ঘরের ছিটানো করা যায়।
তৈরির নিয়ম:
- এক বোতল বিশুদ্ধ পানির মুখ খুলে রাখুন।
- উপরোক্ত আয়াতগুলো পাঠ করে পানিতে ফুঁ দিন।
- এই পানি দিয়ে সকালে ও রাতে অল্প অল্প করে পান করুন।
- সপ্তাহে ২–৩ দিন এই পানি দিয়ে গোসল করতে পারেন।
রুকইয়াহ তেল:
কালোজিরা তেল বা অলিভ অয়েলেও একইভাবে আয়াত পড়ে ফুঁ দিয়ে, ঘুমানোর আগে শরীরে মালিশ করতে পারেন।
৩. ঘর ও পরিবেশের রুকইয়াহ
অনেক সময় জাদু ঘরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় (দরজায়, বিছানায়, কাপড়ে ইত্যাদি)।
এই ক্ষেত্রে ঘরেও রুকইয়াহ করা জরুরি।
পদ্ধতি:
- রুকইয়াহ পানি ঘরে ছিটিয়ে দিন।
- প্রতিদিন ঘরে সূরা আল-বাকারা পাঠ করুন। রাসূল ﷺ বলেছেন:
- “যে ঘরে সূরা আল-বাকারা পাঠ করা হয়, সেখানে শয়তান প্রবেশ করে না।” (সহীহ মুসলিম)
রুকইয়াহ করার সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা
শিরক বা জাদুকরী কোনো আমল ব্যবহার করবেন না। ধৈর্য ধরুন। সিহর অনেক পুরনো হলে পুরোপুরি সেরে উঠতে সময় লাগতে পারে। পাপ থেকে দূরে থাকুন – নামাজ, যিকির, দোয়া, ইস্তিগফার নিয়মিত করুন। রুকইয়াহ চলাকালে জিন বা সিহর প্রকাশ পেলে ভয় পাবেন না। আল্লাহই রক্ষাকারী।
কার্যকর কিছু দোয়া (হাদীস ভিত্তিক)
اللهم رب الناس، أذهب البأس، اشفِ أنت الشافي، لا شفاء إلا شفاؤك، شفاء لا يغادر سقما
অর্থ: “হে মানবজাতির রব, কষ্ট দূর করো, আরোগ্য দাও; তুমি-ই আরোগ্যদানকারী। তোমার আরোগ্য ছাড়া কোনো আরোগ্য নেই।” (সহীহ বুখারী)
أعوذُ بكلماتِ الله التاماتِ من شر ما خلق
অর্থ: “আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালেমার মাধ্যমে আশ্রয় নিচ্ছি তাঁর সৃষ্ট জিনিসের অনিষ্ট থেকে।” (সহীহ মুসলিম)
বিসমিল্লাহিল্লাযি লা ইয়াদুররু মা’আসমিহি শাইউন ফিল আরদি ওয়ালা ফিস সামা…
প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় ৩ বার পড়লে কোনো অনিষ্ট হবে না। (আবু দাউদ)
বাস্তব অভিজ্ঞতায় রুকইয়াহর ফলাফল
অনেক মানুষ ব্যক্তিগতভাবে রুকইয়াহ করার পর জীবনে চমকপ্রদ পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন। যেমন—
- দুঃস্বপ্ন বন্ধ হয়ে যাওয়া,
- মাথার ভার বা মানসিক চাপ হ্রাস,
- নামাজে মনোযোগ ফিরে আসা,
- স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক উন্নতি,
- অজানা ভয় ও উদ্বেগ কমে যাওয়া।
এসব পরিবর্তন ধীরে ধীরে ঘটে, তবে নিয়মিত রুকইয়াহ ও আমল অব্যাহত রাখলে আল্লাহর ইচ্ছায় মুক্তি আসে।
কখন বিশেষজ্ঞ রুকইয়াহ কারী (Raqi)-র সহায়তা নিতে হবে
যদি নিজে রুকইয়াহ করে উপসর্গ কমে না বা জিনের উপস্থিতি খুব প্রবল হয়, তবে অভিজ্ঞ, শরীয়তসম্মত রুকইয়াহ কারী-র সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। তবে মনে রাখবেন, অবিশ্বাস্য তাবিজ, তাবারুক, জাদুকর বা মন্ত্রীর কাছে যাবেন না। তারা জিনের সাহায্য নেয়, যা শিরক ও কুফরি।
উপসংহার
সিহর বা জাদু যতই শক্তিশালী হোক না কেন, আল্লাহর কালাম তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। রুকইয়াহ শারইয়াহ হলো আল্লাহর নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা, যা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে ও শয়তানের প্রভাব নষ্ট করে। নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত, নামাজ, যিকির ও রুকইয়াহ আমল চালিয়ে গেলে, ইনশাআল্লাহ জাদুর প্রভাব পুরোপুরি কেটে যাবে এবং মন-প্রাণ শান্ত হবে।

