ঘরে বসে নিজে রুকইয়াহ করার সহজ পদ্ধতি

ভূমিকা

ঘরে বসে নিজে রুকইয়াহ করার সহজ পদ্ধতি

আজকের যুগে নানা ধরনের মানসিক অশান্তি, অজানা ভয়, দুঃস্বপ্ন, শারীরিক ক্লান্তি বা ঘনঘন অসুস্থতা আমাদের অনেকের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। অনেকে বুঝতে পারেন না — এসব কি কেবল মানসিক সমস্যা, নাকি জিন, শয়তান, বদনজর বা সিহরের প্রভাব।
ইসলামে এসবের প্রতিকার হিসেবে রয়েছে একটি সুন্দর ও নিরাপদ পদ্ধতি — রুকইয়াহ শারইয়াহ। এটি এমন একটি চিকিৎসা যা কুরআন ও সহিহ হাদীসের দোয়া দ্বারা করা হয়। আর সবচেয়ে সুখবর হলো, এটি ঘরে বসেই করা যায় — যদি সঠিক নিয়মে করা হয়।


রুকইয়াহ কী এবং কেন করা হয়

রুকইয়াহ (رُقْيَة) অর্থ দোয়া, কুরআনের আয়াত বা জিকির দ্বারা চিকিৎসা করা।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

“যে কেউ আল্লাহর কিতাবের আয়াত দ্বারা চিকিৎসা করে, তাতে কোনো সমস্যা নেই।”
(সহিহ মুসলিম – 2200)

মূলত নিম্নলিখিত সমস্যার জন্য রুকইয়াহ করা হয়ঃ
  • বদনজর বা ঈর্ষার প্রভাব
  • জিনের কুমন্ত্রণ বা আক্রমণ
  • জাদু বা সিহর
  • মানসিক অস্থিরতা, ভয়, দুঃস্বপ্ন
  • অকারণ অসুস্থতা বা ক্লান্তি

ঘরে বসে নিজে রুকইয়াহ করার প্রস্তুতি

নিজে রুকইয়াহ করার আগে কিছু প্রস্তুতি নিন —

  1. পবিত্র অবস্থায় থাকুন (অজু করে নিন)।
  2. ঘরে আজান দিন অথবা কুরআন তেলাওয়াত চালু রাখুন।
  3. পরিবেশ শান্ত রাখুন – টিভি, মোবাইল বন্ধ রাখুন।
  4. নিয়ত করুন: “আমি আল্লাহর ইচ্ছায় শিফা পাওয়ার জন্য রুকইয়াহ করছি।”

ধাপে ধাপে রুকইয়াহ করার সহজ পদ্ধতি

ধাপ ১️⃣: কুরআন তেলাওয়াত শোনা বা নিজে পড়া

নিম্নোক্ত সূরাগুলো প্রতিদিন পড়া বা শোনা খুব কার্যকর —

  • সূরা ফাতিহা (৭ বার)
  • সূরা আল-বাকারাহ (সম্পূর্ণ বা প্রথম ৫ আয়াত, 255 নং আয়াত — আয়াতুল কুরসী, ও শেষ ২ আয়াত)
  • সূরা আল-ইখলাস, আল-ফালাক, আন-নাস (প্রতিটি ৩ বার)
  • সূরা ইউসুফ: ৩১–৩৪ (বদনজরের ক্ষেত্রে উপকারী)
  • সূরা সাফফাত (১–১০ আয়াত, জিন ও শয়তান থেকে রক্ষায় উপকারী)

করণীয়:
এই আয়াতগুলো ধীরে ধীরে পড়ুন এবং নিজের শরীরে অথবা পানির ওপর ফুঁ দিন।


ধাপ ২️⃣: রুকইয়াহ পানি তৈরি করা

১. এক গ্লাস পানি বা বোতলে পানি নিন।
২. উপরোক্ত সূরা ও আয়াতগুলো পড়ুন।
৩. প্রতিটি সূরা শেষে পানিতে হালকা ফুঁ দিন।
৪. এখন সেই পানি পান করুন এবং কিছু শরীরে ছিটিয়ে দিন (বিশেষ করে মাথা, বুক ও হাত)।

এভাবে প্রতিদিন সকাল ও রাতে রুকইয়াহ পানি পান করুন।


ধাপ ৩️⃣: নিজের ওপর রুকইয়াহ পড়া

১. হাত দুটো একসাথে নিয়ে রুকইয়াহ আয়াতগুলো পড়ুন।
২. তারপর মুখে ফুঁ দিয়ে পুরো শরীরে হাত বুলিয়ে নিন।
৩. বিশেষ করে মাথা, বুক, পেট, ও পিঠে হাত বুলিয়ে দিন।

দোয়া:

“اللهم رب الناس، أذهب البأس، اشف أنت الشافي، لا شفاء إلا شفاؤك، شفاءً لا يغادر سقماً”
অর্থঃ “হে আল্লাহ, মানুষের রব! কষ্ট দূর করুন, আপনি শিফা দানকারী। আপনার শিফা ছাড়া আর কোনো শিফা নেই, এমন শিফা দিন যাতে কোনো রোগ অবশিষ্ট না থাকে।”
(সহিহ বুখারি – 5742)


ধাপ ৪️⃣: রুকইয়াহ তেল ব্যবহার (ঐচ্ছিক)

  • কালোজিরার তেল, জলপাই তেল বা হাব্বাতুস সাওদা তেলে উপরোক্ত আয়াতগুলো পড়ে ফুঁ দিন।
  • এরপর মাথা, বুক ও পেটে লাগান।
  • ঘুমানোর আগে করা উত্তম।

রুকইয়াহ করার সময় করণীয় ও বর্জনীয়

করণীয়

  • প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় রুকইয়াহ করুন (বিশেষত ফজর ও মাগরিবের পর)।
  • পাপ থেকে বেঁচে থাকুন, নামাজ ও জিকিরে স্থির থাকুন।
  • নিজের ঘরে সূরা আল-বাকারাহ নিয়মিত চালান (হাদীসে এসেছে, “যে ঘরে সূরা আল-বাকারাহ পাঠ করা হয়, সেখানে শয়তান প্রবেশ করে না।” – সহিহ মুসলিম)

বর্জনীয়

  • কোনো তাবিজ, কবচ, বা ঝাড়ফুঁকওয়ালা জাদুকরের কাছে যাওয়া।
  • রুকইয়াহকে শুধুমাত্র “জিন তাড়ানোর” উদ্দেশ্যে করা।
  • নিজের ঈমান দুর্বল রাখা বা অলসতা করা।

রুকইয়াহর ফলাফল কবে পাওয়া যায়?

রুকইয়াহ কোনো জাদুর মতো তাৎক্ষণিক ফল দেয় না। এটি আল্লাহর ইচ্ছায় একটি ধৈর্য ও আমলের চিকিৎসা।
যদি আপনি নিয়মিত পড়েন, নামাজে মনোযোগ রাখেন, এবং পাপ থেকে দূরে থাকেন, তাহলে ধীরে ধীরে শরীর ও মন উভয়েই পরিবর্তন টের পাবেন ইনশাআল্লাহ।


উপসংহার

রুকইয়াহ শারইয়াহ হলো একমাত্র ইসলামসম্মত আত্মিক চিকিৎসা পদ্ধতি, যা ঘরে বসেই করা সম্ভব। এতে নেই কোনো ঝুঁকি, নেই কোনো শির্ক বা জাদু। বরং এটি আমাদের ঈমানকে শক্তিশালী করে এবং আল্লাহর ওপর নির্ভরতা বাড়ায়।

“আর আমরা কুরআনে এমন কিছু অবতীর্ণ করেছি যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত।”
— (সূরা ইসরা: ৮২)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top