ভূমিকা
আমাদের জীবনে এমন অনেক সময় আসে যখন হঠাৎ করে সবকিছু যেন উল্টে যেতে থাকে — মন খারাপ লাগে, অস্থিরতা কাজ করে, কাজের আগ্রহ হারিয়ে যায়, শরীর ভারী মনে হয়, মুখে হাসি থাকে না, এমনকি কোনো কারণ ছাড়াই দুঃখে ভরে ওঠে মন। অনেক সময় এসব অবস্থার পেছনে থাকতে পারে বদনজর (Evil Eye)। ইসলামে বদনজরের অস্তিত্ব সত্য, এবং এর প্রভাব অনেক গভীর।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুরআনে বলেনঃ
وَإِن يَكَادُ الَّذِينَ كَفَرُوا لَيُزْلِقُونَكَ بِأَبْصَارِهِمْ
“অবিশ্বাসীরা তাদের দৃষ্টির দ্বারা তোমাকে প্রায় বিপদগ্রস্ত করে ফেলতো।”
(সূরা কলম: ৫১)
এই আয়াত থেকেই বোঝা যায় — মানুষের দৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষতি হতে পারে। তবে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কিছুই ক্ষতি করতে পারে না। তাই বদনজর থেকে বাঁচার জন্য আমাদের উচিত আল্লাহর নির্দেশিত রুকইয়াহ পদ্ধতি মেনে চলা।
এই আর্টিকেলে আমরা শিখবো কীভাবে নিজেই ঘরে বসে বদনজরের রুকইয়াহ (Self Ruqyah) করা যায়— সহজ, শরয়ী ও কার্যকর উপায়ে।

বদনজর কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে?
বদনজর (Al-Ayn) অর্থ এমন এক ক্ষতিকর দৃষ্টি যা হিংসা, ঈর্ষা, অতিরিক্ত প্রশংসা বা অন্যের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ঘটে। কেউ যখন ঈর্ষান্বিত মনে কোনো কিছু দেখে, তখন তার চোখের দৃষ্টির মাধ্যমে শয়তানের প্ররোচনায় ক্ষতি সংঘটিত হতে পারে।
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“বদনজর বাস্তব।”
(সহিহ মুসলিম, হাদীস: 2188)
অর্থাৎ বদনজর এমন এক বাস্তব বিষয় যা মানুষকে শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে ক্ষতি করতে পারে।
বদনজরের লক্ষণসমূহ
যদি নিচের একাধিক লক্ষণ তোমার মাঝে দেখা দেয়, তাহলে বদনজর লাগার সম্ভাবনা আছে —
- হঠাৎ করে মন খারাপ লাগা বা অস্থিরতা অনুভব।
- কোনো কারণ ছাড়াই মাথা ব্যথা বা শরীর ভারী লাগা।
- বারবার কাজের ব্যর্থতা বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
- মুখে রঙ পরিবর্তন, চোখ জ্বালাপোড়া।
- দুঃস্বপ্ন বা ঘুমের সমস্যা।
- বাচ্চাদের ক্ষেত্রে হঠাৎ কান্না শুরু করা, খাওয়ায় অনীহা।
- ব্যবসা বা জীবনে অজানা অস্বাভাবিক ক্ষতি।
এগুলো বদনজরের সাধারণ লক্ষণ। এখন দেখা যাক, কীভাবে আমরা ঘরে বসে নিজেই রুকইয়াহ করতে পারি।
সেলফ রুকইয়াহ করার প্রস্তুতি
রুকইয়াহ করার আগে কিছু প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি —
- পরিপূর্ণ তাওহীদে বিশ্বাস রাখো:
রুকইয়াহর আসল শক্তি কোনো আয়াত বা শব্দে নয়, বরং আল্লাহর কুদরতে। তাই আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখো। - পবিত্র অবস্থায় থাকো:
ওযু করে বসো, জামাকাপড় ও স্থান পরিষ্কার রাখো। - শান্ত জায়গা নির্বাচন করো:
যেখানে মনোযোগ ভাঙবে না, এমন একটি নিরিবিলি জায়গা নাও। - নিয়্যত ঠিক করো:
মন থেকে নিয়্যত করো — “আমি বদনজর মুক্তির উদ্দেশ্যে আল্লাহর উপর ভরসা করে রুকইয়াহ করছি।”
সেলফ রুকইয়াহ করার ধাপসমূহ (Step by Step Guide)
১️ সূরা ফাতিহা পড়া
৭ বার সূরা ফাতিহা পড়বে। এটি “শিফার সূরা” নামে পরিচিত।
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
“আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন…”
এই সূরা শরীর ও আত্মার রোগ থেকে মুক্তি দেয়।
২️ সূরা আল-বাকারা’র কিছু আয়াত
যদি সম্ভব হয়, প্রতিদিন কিছু অংশ করে সূরা আল-বাকারা তেলাওয়াত করো।
বিশেষ করে নিম্নের আয়াতগুলো:
- আয়াতুল কুরসি (সূরা বাকারা ২৫৫)
- শেষ দুই আয়াত (২৮৫-২৮৬)
রাসুল ﷺ বলেছেন:
“যে ব্যক্তি রাতে সূরা আল-বাকারা’র শেষ দুই আয়াত পড়ে, তা তার জন্য যথেষ্ট।”
(সহিহ বুখারী, ৫০০৯)
৩️ সূরা আল-ইখলাস, সূরা আল-ফালাক ও সূরা আন-নাস
এই তিনটি সূরাকে “মুআউযাতাইন” বলা হয়, যা রুকইয়াহর মূল অংশ।
প্রতিটি সূরা ৩ বার করে পড়বে, এবং প্রত্যেকবার পড়ার পর নিজের শরীরে ফুঁ দিবে বা হাত দিয়ে মুখ ও শরীর মুছে নিবে।
“قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ…”
“قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ…”
এই সূরাগুলো শয়তান, জিন, বদনজর, ও সকল অশুভ শক্তি থেকে সুরক্ষা দেয়।
৪️ নির্দিষ্ট দোয়া ও আয়াত পাঠ
নিচের আয়াত ও দোয়াগুলো নিয়মিত পড়া অত্যন্ত কার্যকরঃ
সূরা ইউনুস – আয়াত ৮১-৮২
“আল্লাহ নষ্ট করেন জাদু ও মিথ্যা কাজ।”
সূরা ত্বাহা – আয়াত ৬৯
“যা কিছু তারা বানিয়েছে তা শুধু জাদুকরের কৌশল; আল্লাহ তা ব্যর্থ করবেন।”
দোয়া:
أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ
“আমি আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ কালিমাগুলোর মাধ্যমে তাঁর সৃষ্ট সকল মন্দ থেকে আশ্রয় চাই।”
(সহিহ মুসলিম)
এই দোয়াটি দিনে তিনবার পড়া অত্যন্ত উপকারী।
৫️ রুকইয়াহ পানি প্রস্তুত করা
রুকইয়াহ করার সময় পানি ব্যবহার করলে প্রভাব আরও দ্রুত দেখা যায়।
পদ্ধতি:
- এক গ্লাস বা বোতল পানি নাও।
- উপরোক্ত সূরা ও দোয়াগুলো পড়ে পানিতে ফুঁ দাও।
- পানি থেকে অল্প অল্প করে পান করো এবং কিছু পানি শরীরে ছিটাও বা গোসলের সময় ব্যবহার করো।
এই পানিতে দোয়ার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে ইনশাআল্লাহ।
সেলফ রুকইয়াহ করার সময় মনে রাখার বিষয়সমূহ
আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করো।
ভয় বা আতঙ্ক নয়, বিশ্বাস ও শান্ত মনে করো।
কোনো তাবিজ, কবজ বা অদ্ভুত পদ্ধতি ব্যবহার করো না — এগুলো শরীয়ত বিরোধী।
রুকইয়াহ করার সময় নিয়মিত আযান, নামাজ ও যিকর অব্যাহত রাখো।
রুকইয়াহ করার পর মন শান্তি অনুভব করলে আলহামদুলিল্লাহ বলো; না হলে ধৈর্য ধরে নিয়মিত করো।
বদনজর থেকে বাঁচার প্রতিরোধমূলক আমল
রুকইয়াহ করার পাশাপাশি নিচের অভ্যাসগুলো বজায় রাখলে বদনজর পুনরায় লাগার আশঙ্কা কমে যায় —
- প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় আযকার পাঠ করো।
যেমন —
“বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়াদুররু মা’আস্মিহি শাইউন ফিল আরদি ওয়ালা ফিস সামা’…”
- নিজে বা অন্যের প্রশংসা করার সময় “মাশাআল্লাহ” বলো।
এতে বদনজর থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। - নামাজ নিয়মিত পড়ো।
নামাজ হলো আত্মার রুকইয়াহ। - বাচ্চাদের জন্য রুকইয়াহ করো।
রাসুল ﷺ তাঁর নাতি হাসান ও হুসাইনের জন্য বলতেন —
“أُعِيذُكُمَا بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ…”
- বাড়িতে সূরা আল-বাকারা তেলাওয়াত করো।
এই সূরা পড়লে শয়তান ঘর থেকে পালায়।
সেলফ রুকইয়াহ করার পর কী আশা করা যায়
রুকইয়াহ করার পর অনেক সময় মানুষ —
- হালকা ক্লান্তি অনুভব করে
- হাই আসে
- কাঁদতে ইচ্ছে হয়
- মাথা ভারি লাগে বা বমি ভাব হয়
এসব উপসর্গ রুকইয়াহ কার্যকর হওয়ার প্রমাণ, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। শরীর ও আত্মা থেকে নেতিবাচক শক্তি বেরিয়ে যাচ্ছে — এটাই ভালো লক্ষণ।
কিছুদিনের মধ্যে মন হালকা হবে, ঘুম ভালো হবে, দুঃস্বপ্ন কমে যাবে, এবং জীবনে আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ্য করবে ইনশাআল্লাহ।
শেষ কথা
বদনজর বাস্তব, কিন্তু এর ভয় কখনোই আল্লাহর শক্তির চেয়ে বড় নয়। মনে রেখো — আল্লাহই একমাত্র রক্ষাকারী।
তুমি যতই রুকইয়াহ করো না কেন, আসল ফলাফল আসে নিয়্যত, ধৈর্য, এবং তাওয়াক্কুল (আল্লাহর উপর ভরসা) থেকে।
আল্লাহ বলেনঃ
وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ
“যে আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট।”
(সূরা আত-তালাক: ৩)
তাই বদনজর থেকে মুক্তি চাও আল্লাহর কাছে, নিয়মিত রুকইয়াহ করো, আর মন ও আত্মাকে পরিশুদ্ধ রাখো। ইনশাআল্লাহ, তুমি শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরে পাবে।

