ভূমিকা
মানুষের জীবনে ভয়, উদ্বেগ এবং দুঃস্বপ্ন এমন কিছু বিষয় যা মানসিক প্রশান্তি নষ্ট করে দেয়। কারো ঘুমের মধ্যে বারবার ভয়াবহ দৃশ্য আসে, কেউ হঠাৎ করে বুক ধড়ফড়, ঘাম বা আতঙ্কে জেগে ওঠে—আবার কেউ নিরবচ্ছিন্ন দুশ্চিন্তায় ভুগে থাকে। আধুনিক চিকিৎসা বলে, এটি মানসিক সমস্যা বা স্ট্রেসের ফল। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে কখনো কখনো এই ভয় বা উদ্বেগ শয়তানের কুমন্ত্রণা, বদনজর কিংবা জিনের প্রভাবের কারণেও হতে পারে। ভয় উদ্বেগ ও দুঃস্বপ্ন দূর করার রুকইয়াহ
এই সময় কুরআন ও সহিহ হাদীসসমূহে নির্ধারিত রুকইয়াহ শারইয়াহ (Ruqyah Shar’iyyah) হলো সবচেয়ে উত্তম আধ্যাত্মিক চিকিৎসা। এটি এমন এক পদ্ধতি যেখানে কুরআনের নির্দিষ্ট আয়াত ও দোয়া পাঠ করে আল্লাহর কাছে আরোগ্য ও প্রশান্তি প্রার্থনা করা হয়।
রুকইয়াহ কী এবং কেন প্রয়োজন?
“রুকইয়াহ” শব্দটি আরবি “رُقْيَة” থেকে এসেছে, যার অর্থ পাঠ করা, দোয়া করে ফুঁ দেওয়া বা রক্ষা চাওয়া।
রুকইয়াহ ইসলামীভাবে বৈধ তখনই, যখন তাতে শিরক, অজানা শব্দ, তাবিজ বা জাদুবিদ্যার উপাদান থাকে না। বরং কেবল কুরআন, আল্লাহর নাম এবং সহিহ দোয়াগুলোর মাধ্যমেই রুকইয়াহ করা হয়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে, তা শিফার মাধ্যম হয়।”
(সহিহ বুখারী 5736)
আবার তিনি বলেন:
“যে ব্যক্তি সূরা আল-বাকারা পাঠ করে, তার ঘরে শয়তান প্রবেশ করে না।”
(সহিহ মুসলিম 780)
অতএব, ভয়, উদ্বেগ ও দুঃস্বপ্নের মতো সমস্যায় রুকইয়াহ আল্লাহর রহমতের এক চমৎকার পথ।
ভয় ও উদ্বেগের কারণসমূহ
ভয় বা উদ্বেগ (Fear & Anxiety) অনেক কারণেই হতে পারে। নিচে তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো—
- মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা: অতিরিক্ত স্ট্রেস, চিন্তা, অর্থনৈতিক সমস্যা বা পারিবারিক চাপ।
- জিন বা শয়তানের প্রভাব: অনেক সময় অদৃশ্য সত্তার প্রভাবে মানুষ ভয় পায়, হঠাৎ দুঃস্বপ্ন দেখে।
- বদনজর বা হিংসা: অন্যের ঈর্ষার কারণে মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।
- তাওয়াক্কুলের অভাব: আল্লাহর প্রতি আস্থা ও নির্ভরতা কমে গেলে মন অস্থির হয়ে পড়ে।
- অতীতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা: ট্রমা বা ভয়ানক স্মৃতি থেকেও ভয় ফিরে আসতে পারে।
যে কারণই হোক, আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা ও নিয়মিত রুকইয়াহ করলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
রুকইয়াহ করার আগে করণীয়
রুকইয়াহ শুরু করার আগে কিছু প্রস্তুতি নেয়া গুরুত্বপূর্ণ:
- নিয়ত পরিষ্কার করুন:
মনে রাখুন, আরোগ্য কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। তাই রুকইয়াহ করার উদ্দেশ্য যেন আল্লাহর সন্তুষ্টি হয়। - পবিত্র অবস্থায় থাকুন:
ওযু করুন, পরিচ্ছন্ন পোশাক পরুন এবং কিবলামুখী হয়ে বসুন। - মনোযোগী হোন:
রুকইয়াহর সময় হৃদয় দিয়ে মনোযোগ দিন। অযথা শব্দ, মোবাইল, টিভি বন্ধ রাখুন। - সুগন্ধি ব্যবহার করুন:
আতর বা মিশক ঘরে ছড়িয়ে দিলে পরিবেশ শান্ত হয় এবং মন প্রশান্ত থাকে।
ভয়, উদ্বেগ ও দুঃস্বপ্ন দূর করার রুকইয়াহ দোয়া ও আয়াতসমূহ
নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আয়াত ও দোয়া দেওয়া হলো, যেগুলো ভয়, উদ্বেগ ও দুঃস্বপ্নের জন্য কার্যকর রুকইয়াহ হিসেবে প্রমাণিত। ভয় উদ্বেগ ও দুঃস্বপ্ন দূর করার রুকইয়াহ
১️⃣ সূরা আল-ফাতিহা
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ …
এই সূরাটি সাতবার পাঠ করে নিজের মাথায়, বুকে বা শরীরে ফুঁ দিন।
এটি শিফার সূরা, অর্থাৎ রোগ ও ভয় দূর করার আয়াত।
২️⃣ আয়াতুল কুরসি (সূরা আল-বাকারা: ২৫৫)
اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ …
রাসূল ﷺ বলেছেন,
“যে ব্যক্তি রাতে আয়াতুল কুরসি পাঠ করবে, আল্লাহ তার জন্য এক ফেরেশতা নিযুক্ত করবেন, যে সকাল পর্যন্ত পাহারা দেবে।”
(সহিহ বুখারী 2311)
ভয় বা দুঃস্বপ্নে ভুগলে ঘুমানোর আগে এই আয়াত অবশ্যই পড়তে হবে।
৩️⃣ সূরা আল-ইখলাস, সূরা আল-ফালাক ও সূরা আন-নাস
এই তিনটি সূরা রাসূল ﷺ প্রতিরাতে পড়তেন এবং নিজের শরীরের ওপর ফুঁ দিতেন।
এগুলোকে একত্রে মুআউইযাত (ত্রয়ী সুরা) বলা হয়।
(সহিহ বুখারী 5017)
এই তিন সূরা জিন, বদনজর, ভয় ও দুঃস্বপ্ন থেকে রক্ষা করে।
৪️⃣ ভয় ও উদ্বেগ দূর করার বিশেষ দোয়া
اللّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الهَمِّ وَالحَزَنِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ العَجْزِ وَالكَسَلِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الجُبْنِ وَالبُخْلِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ غَلَبَةِ الدَّيْنِ وَقَهْرِ الرِّجَالِ
অর্থ:
“হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয় চাই দুঃখ ও উদ্বেগ থেকে, অক্ষমতা ও আলস্য থেকে, কাপুরুষতা ও কৃপণতা থেকে, ঋণের ভার ও মানুষের অত্যাচার থেকে।”
(সহিহ বুখারী 6369)
প্রতিদিন সকালে ও রাতে অন্তত একবার এই দোয়া পড়া উচিত।
৫️⃣ দুঃস্বপ্ন দেখলে করণীয়
রাসূল ﷺ বলেছেন:
“যে ব্যক্তি দুঃস্বপ্ন দেখে, সে যেন বাম দিকে তিনবার হালকা থুথু ফেলে এবং আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে। যেন সে কাউকে সেই স্বপ্ন না বলে।”
(সহিহ বুখারী 7045)
এছাড়া, দুঃস্বপ্নের পর
- সূরা আল-ফালাক ও আন-নাস পড়বেন
- “আয়াতুল কুরসি” পড়বেন
- বিছানা পরিবর্তন বা ওযু করে পুনরায় ঘুমাতে পারেন
ঘরে বসে রুকইয়াহ করার পদ্ধতি
১. রুকইয়াহ পানি প্রস্তুত:
এক গ্লাস পানি নিয়ে উপরোক্ত আয়াতগুলো ও দোয়াগুলো পাঠ করে ফুঁ দিন। সেই পানি পান করুন বা মাথা ও বুকে ছিটিয়ে দিন।
২. রুকইয়াহ তেল ব্যবহার:
অলিভ অয়েল বা কালোজিরা তেলে একইভাবে আয়াতগুলো পাঠ করে ফুঁ দিন। প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে বুকে, মাথায়, কপালে হালকা করে মেখে নিন।
৩. রুকইয়াহ অডিও শুনুন:
বিশ্বস্ত আলেমদের রুকইয়াহ অডিও (যেমন শেখ মিশারি রশিদ বা শেখ মাহের আল-মুয়াইকেল-এর তেলাওয়াত) দিনে একবার শুনুন।
৪. ঘর পরিশুদ্ধ রাখুন:
ঘরে কুরআন তেলাওয়াত চালু রাখুন, অশ্লীল গান বা চিত্র সরিয়ে ফেলুন।
৫. নিয়মিত আমল:
- ফজর ও মাগরিবের পর তিনটি সূরা পাঠ করুন।
- রাতে ঘুমানোর আগে “আয়াতুল কুরসি” ও “মুআউইযাত” পড়ুন।
- সকালে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” ও “আস্তাগফিরুল্লাহ” বারবার বলুন।
রুকইয়াহ করার সময় যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে
- রুকইয়াহতে কোনো তাবিজ, যাদু বা অজানা ভাষা ব্যবহার করা যাবে না।
- রুকইয়াহ কেবল কুরআন ও সহিহ দোয়াগুলোর মাধ্যমেই করতে হবে।
- রুকইয়াহ করার সময় আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখতে হবে।
- ভয় বা উদ্বেগ যদি চিকিৎসাগত হয়, তবে ডাক্তারের পরামর্শও নিতে হবে—ইসলাম চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহ দিয়েছে।
- রুকইয়াহর সময় সবসময় পবিত্র থাকা ও নামাজে নিয়মিত থাকা অপরিহার্য।
রুকইয়াহর সুফল ও পরিবর্তন
রুকইয়াহ করলে ধীরে ধীরে দেখা যায়—
- ভয় ও উদ্বেগ কমে যায়
- দুঃস্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়
- মন হয় প্রশান্ত ও হালকা
- নামাজে মনোযোগ বাড়ে
- আত্মবিশ্বাস ও ঈমান বৃদ্ধি পায়
যখন কেউ আন্তরিকভাবে কুরআন পাঠ করে রুকইয়াহ করে, তখন তার অন্তর প্রশান্ত হয়। আল্লাহ বলেন,
“নিশ্চয়ই আল্লাহর স্মরণেই অন্তর প্রশান্ত হয়।”
(সূরা রা’দ: ২৮)
মানসিক শান্তির জন্য অতিরিক্ত আমল
- নামাজে খুশু-খুযু বৃদ্ধি করা।
- সূরা আল-বাকারা ঘরে পাঠ করা।
- প্রতিদিন সকালে ও রাতে যিকির করা।
- রাতের তাহাজ্জুদে কেঁদে আল্লাহর কাছে মনের ভয় প্রকাশ করা।
যখন তুমি আল্লাহর কাছে মন খুলে কাঁদবে, তখন ভয় ও উদ্বেগ আস্তে আস্তে গলে যাবে—যেমন সূর্যের তাপে বরফ গলে যায়।
উপসংহার
ভয়, উদ্বেগ ও দুঃস্বপ্ন মানুষকে দুর্বল করে দেয়। কিন্তু মুসলমান হিসেবে আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে—শিফা শুধুমাত্র আল্লাহর হাতে। রুকইয়াহ হলো কুরআন ও দোয়ার মাধ্যমে সেই শিফা লাভের অন্যতম পথ।
যদি তুমি নিয়মিত রুকইয়াহ করো, নামাজে মনোযোগ দাও, যিকির ও দোয়ায় লেগে থাকো, তাহলে ইনশাআল্লাহ তুমি ভয়, উদ্বেগ ও দুঃস্বপ্ন থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পাবে।

